আশিকুর রহমান :-
নরসিংদী সদর উপজেলার মেঘনা নদীর উপর নির্মিত নাগরিয়াকান্দি শেখ হাসিনা সেতু যেন চরাঞ্চল মানুষের জন্য মড়ার উপর খাঁড়া ঘা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেতুর দু’পাশে নামে-বেনামে গড়ে ওঠা একাধিক পার্ক ও অবৈধ দোকানের ফলে বর্তমানে সেতুটি মড়ার উপর খাঁড়া ঘা হয়ে ওঠেছে বলে স্থানীয় বাসিন্দারা মনে করেন।
রাজধানী ঢাকার নিকটবর্তী শিল্প-বাণিজ্য সমৃদ্ধ এক জনপদ নরসিংদী। এই জেলার সদর উপজেলার মধ্যে দিয়ে মেঘনা নদী প্রবাহিত। নদীটি চরাঞ্চলের ৩টি ইউনিয়ন নজরপুর, করিমপুর ও আলোকবালি ইউনিয়নকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিল। এই তিন ইউনিয়নের প্রায় ২৫ হাজার মানুষ প্রতিদিন নরসিংদী শহর, রাজধানী ঢাকা সহ বিভিন্ন জেলায় চিকিৎসা, কৃষি-ব্যবসা ও শিক্ষার জন্য যাতায়াত করতে হতো। বর্ষাকালে তাদের যাতায়াতে চরম অসুবিধায় পড়তে হতো। চরাঞ্চলবাসীর দীর্ঘদিনের দাবি ছিলো মেঘনা নদীর উপর সেতু নির্মাণ। চরাঞ্চল বাসীর দীর্ঘদিনের আক্ষেপ মেটাতে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্হা উন্নয়নের মাধ্যমে আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন সহ চরাঞ্চলের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গতি আনার জন্য নরসিংদী সদর-১ আসনের সংসদ সদস্য মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম (বীর প্রতীক) এমপির একান্ত প্রচেষ্টায় ২০১০ সালের ৯ মার্চ প্রধানমন্ত্রীর একনেক বৈঠকে এ দীর্ঘ সেতুটি নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। সেতুটি নির্মাণ করতে প্রায় ৯৭ কোটি ৮০ লক্ষ টাকা ব্যয় করা হয়। সেতুটি নির্মাণের ফলে চরাঞ্চলের প্রায় ২৫ হাজার মানুষ অনায়াসে নরসিংদী শহর, রাজধানী ঢাকা সহ বিভিন্ন জেলার সাথে সরাসরি যোগাযোগ করা সহজতর হয়ে ওঠে। দূর্গম চরাঞ্চলবাসীর জন্য মেঘনা নদীর উপর নির্মিত ব্যয়বহুল সেতুটি একনজর দেখতে জেলা শহর সহ আশপাশের জেলা থেকে বিভিন্ন স্তরে লোকজন এখানে ছুটে আসেন। সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে কথিত কিছু স্থানীয় লোক সেতুর দু’পাশের কৃষি জমিতে মাটি ভরাট করে নামে-বেনামে একাধিক পার্ক, রেস্তোরাঁ, ও দোকানপাট গড়ে তুলেন। এসব পার্ক, রেস্তোরাঁ ও দোকানপাট নির্মাণে সরকারের নিয়ম-নীতি না মেনে তৈরি হওয়ায় প্রতিনিয়ত সৃষ্ট হচ্ছে যানজট। এতে চরাঞ্চল বাসীকে প্রতিনিয়ত পোহাতে হচ্ছে চরম দূর্ভোগ।
সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ঈদের ছুটিতে জেলা ও জেলার বাইরে থেকে সেতু ও আশপাশ এলাকা পরিবার-পরিজন নিয়ে ঘুরতে আসছেন। বেলা বাড়ার সাথে সাথে দর্শনার্থীর সংখ্যাও বাড়তে থাকে। তাদের বহন করা নিজস্ব ও ভাড়া করা গাড়ি, ইজিবাইক, বিভাটেক সেতুর সংযোগ সড়কেই পার্কিং করে আছেন। গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গা না থাকায় তারা সড়কেই যাত্রী ওঠানামা করছেন। ফলে সেতু ও সেতুর দু’পাশের প্রায় কয়েক কিলোমিটার সড়কে সৃষ্টি হয়েছে তীব্র যানজট। যানজট নিরসনে স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। পরে যানজট নিরসনে ব্যর্থ হয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সেতুর উপর গাড়ি চলাচল বন্ধ করে দেন।
পার্কে দর্শনার্থী নিয়ে আসা এক ইজিবাইকের চালক বলেন, শিবপুর থেকে যাত্রী নিয়ে রিজার্ভ এসেছি। যাত্রীরা নেমে পার্কে চলে গেছে। পার্কিংয়ের জায়গা না থাকায় গাড়ি রাস্তায় রাখতে হচ্ছে। করিমপুরের ইজিবাইক চালক বলেন, প্রতিদিন আমরা করিমপুর থেকে যাত্রী নিয়ে নরসিংদী আসি। এ রাস্তায় নিয়মিত আমাদের চলাচল। পার্ক ও রেস্তোরাঁ হয়েছে ভাল কথা। এসব পার্ক ও রেস্তোরাঁ হওয়ার আগে গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্হা করার উচিত ছিল। এখন যাত্রী নিয়ে নরসিংদী যাবো। যেতে পারছিনা। দীর্ঘ এক ঘন্টা ধরে রাস্তায় বসে রয়েছি। গাড়ি ঘুরিয়ে আবার করিমপুর ফিরে যাবো সেই অবস্থাও নাই। প্রাইভেটকারের চালক বলেন, কি করবো, পার্ক করছে পার্কিংয়ের জায়গা না করে। এখন গাড়ি কই রাখবো? তাই গাড়ি রাস্তায় রাখতে বাধ্য হয়েছি। ঘুরতে আসা একাধিক দর্শনার্থী বলেন, প্রচন্ড ভীড় ও তীব্র যানজট। ইউএমসি জুট মিলের গেইট থেকে প্রায় ২ কিলোমিটার রাস্তা কষ্ট করে পায়ে হেঁটে শেখ হাসিনা সেতুতে এসেছি। পরিকল্পনা অনুযায়ী বিনোদন স্পট তৈরির পাশাপাশি গাড়ি পাকিংয়ের ব্যবস্হা করলে এ যানজটের সৃষ্টি হতো না। নেই কোনো পাবলিক টয়লেটও। আর সড়কের পাশ ঘিরে তৈরি হয়েছে রেস্তোরাঁ ও দোকানপাট। এসব রেস্তোরাঁ ও দোকানপাট সড়ক থেকে কয়েক হাত দূরে করলে যানজট কিছুটা হলেও কম হতো বলে তিনি মন্তব্য করেন। নজরপুর ও করিমপুর ইউনিয়নের একাধিক ব্যক্তি বলেন, সেতু না। চরের মানুষের জন্য এটা এখন মড়ার উপর খাঁড়া ঘা হইছে। বৃহস্পতিবার বিকাল থেকে শুরু হয়ে শনিবার রাইত পর্যন্ত এমন যানজট সৃষ্টি হয়। রোগী লইয়া হাসপাতালে বা জরুরি কাজে নরসিংদী যাইতে পারি না। আর সরকারী কোনো উৎসব বা ছুটি থাকলে দেহ্যা যায় ব্রীজের উপর কেমন পারাপারি। মানুষের কারণে গাড়ি বন্ধ করে দিছে। না পারি নরসিংদী যাইতাম না পারি বাড়ি আইতাম। এ থেকে আমরা পরিত্রাণ চাই।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় ইউপি সদস্য বলেন, চরাঞ্চলবাসীর দীর্ঘদিনের দাবি ছিলো মেঘনা নদীর উপর সেতু নির্মাণ। আমাদের মাননীয় সংসদ সদস্য মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম হিরো (বীর প্রতীক) মহোদয়ের একান্ত প্রচেষ্টায় কাঙ্ক্ষিত সেই সেতু নির্মাণ করেছিলেন চরবাসীর সুবিধার জন্য। কিন্তু এখন সুবিধা থেকে বেশি দুর্ভোগই পোহাতে হচ্ছে। দুইদিন ধরে গাড়ি চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে। এখন আগুনের মত দূর্ঘটনা ঘটলে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ও গুরুত্বর অসুস্থ রোগী নিয়ে হাসপাতালে যাওয়া যাওয়া যায় না। তিনি আরও জানান, ইউনিয়ন পরিষদ ও জেলা প্রশাসনের অনুমতিপত্র ছাড়াই সেতুর দু’পাশে রাস্তার ধারে যত্রতত্রে নির্মাণ করা হচ্ছে রেস্তোরাঁ, দোকানপাট ও পার্ক। এসব প্রতিষ্ঠান তৈরি করতে হলে নিতে হবে অনুমতি। আর রাখতে হবে গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্হা। এগুলোর একটাও নেই তাদের। যার যখন ইচ্ছে হচ্ছে সে-ই দোকানপাট, রেস্তোরাঁ ও পার্ক নির্মাণ করছে। ফলে নরসিংদী-নজরপুর-করিমপুর সড়কে সৃষ্টি হচ্ছে যানজট। চরাঞ্চল বাসীর এ দুর্ভোগ লাঘব করতে প্রশাসনের দ্রুত হস্তক্ষেপ কামনা করছি।
পরিবেশ বিশ্লেষকরা মনে করেন সুস্থ সমাজে বসবাস করতে হলে অবশ্যই বিনোদনের প্রয়োজন আছে। কোনো স্থানে বিনোদন স্পট নির্মাণ করতে হলে অবশ্যই পরিবেশ ও ভবিষ্যত অবকাঠামো পরিকল্পনা অনুযায়ী করতে হবে। প্রথমেই চিন্তা করতে হবে সুস্থ বিনোদনের জন্য সুস্থ পরিবেশ। সেজন্য মানতে হবে সরকারের সুনির্দিষ্ট নীতিমালা। পাশাপাশি সড়কের পাশে দোকানপাট নির্মাণ ও বিনোদন স্পট নির্মাণ করা থেকে বিরত থাকতে হবে।